ঘরের ছেলের চক্ষে দেখেছি
বিশ্বভূপের ছায়া
বাঙালির হিয়া অমিয় মথিয়া
নিমাই ধরেছে কায়া
—সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
—সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
গোদাবরীতীরে রায় রামানন্দের সঙ্গে আলোচনার সময় সাধ্যতত্ত্ব সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন শ্রীচৈতন্য – ‘পঢ় শ্লোক সাধ্যের নির্ণয়’।
লক্ষণীয়, শ্রীচৈতন্য ‘শ্লোক’ শুনতে চেয়েছিলেন। অর্থাৎ, শাস্ত্রীয় যুক্তিভিত্তিক আলোচনার প্রতি তাঁর আগ্রহ। সাধ্যতত্ত্ব বিষয়ে রামানন্দের ব্যক্তিগত অভিমত বা উপলব্ধি তিনি শুনতে চাননি।
রামানন্দ প্রথমেই সাধ্যতত্ত্ব সম্পর্কে অতি নিগূঢ় কথা শ্রীচৈতন্যকে বলতে চাননি। প্রথমে রামানন্দ বলেছিলেন, ‘স্বধর্মাচরণে বিষ্ণুভক্তি হয়’। স্বধর্মাচরণ মানে নিজের ধর্ম আচরণ। এক্ষেত্রে তা বর্ণাশ্রমধর্মকে বোঝাচ্ছে। কিন্তু বস্তুতই বর্ণাশ্রমধর্ম পালন চূড়ান্ত সাধ্যবস্তুরূপে পরিগণিত হতে পারে না। কারণ, বর্ণাশ্রমধর্ম কর্মমিশ্রা ভক্তির অন্তর্গত। অথচ, জীবের অভিপ্রেত হল শুদ্ধাভক্তি বা পঞ্চম পুরুষার্থ প্রেমভক্তি। ‘ভক্তিরসামৃতসিন্ধু’ এই উত্তমা শুদ্ধাভক্তির সংজ্ঞা নির্দেশ করছেন – ‘অন্যাভিলাষিতাশূন্যং জ্ঞানকর্মাদ্যনাবৃতম্ আনুকূল্যেন কৃষ্ণানুশীলনং ভক্তিরুত্তমা’। উল্লিখিত ‘জ্ঞানকর্মাদ্যনাবৃতম্’ অংশে ঈশ্বরের সঙ্গে প্রেমসম্পর্কহীন স্বধর্মাচরণকে শুদ্ধাভক্তির শ্রেণি থেকে নাকচ করা হচ্ছে। তাই চতুর্বর্ণ এবং চতুরাশ্রম প্রথা অনুযায়ী কর্মপালনই যথেষ্ট – রামানন্দের এই বক্তব্যকে নিতান্ত বাইরের (‘এহো বাহ্য’) বিষয় বলে চিহ্নিত করলেন শ্রীচৈতন্য।
এরপর রামানন্দ জানালেন, ‘কৃষ্ণে কর্মাপর্ণ সাধ্যসার’। স্বধর্মাচরণ বেদবিহিত সকাম কর্ম। ফলে স্বধর্মাচরণের মাধ্যমে কর্মবন্ধন থেকে মুক্তিলাভ করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে, শ্রীকৃষ্ণে কর্মার্পণ করলে কর্মবন্ধন ছিন্ন করা যায়। তাই স্বধর্মাচরণের তুলনায় শ্রীকৃষ্ণে কর্মার্পণ শ্রেয়। তবু শ্রীচৈতন্য শ্রীকৃষ্ণে কর্মার্পণকে ‘এহো বাহ্য’ বলে অভিহিত করলেন। কারণ, স্বধর্মাচরণের মতো এটিও মিশ্রাভক্তি। তবে স্বধর্মাচরণ সকাম, এটি নিষ্কাম। শ্রীকৃষ্ণে কর্মার্পণের উদ্দেশ্য: নিজে কর্মবন্ধন থেকে মুক্তিলাভ করা। নিজের মুক্তি চাওয়া হচ্ছে মানে এখনও দেহাবেশ বা নিজের জন্য ভাবনা রয়েছে। শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে জীবের সেব্য-সেবক সম্পর্কের স্বরূপ এখানে প্রকাশিত নয়। তাই শ্রীকৃষ্ণে কর্মার্পণকে কৃষ্ণসুখৈক তাৎপর্যময়ী শুদ্ধাভক্তি বলা যায় না।
তৃতীয় ধাপে, রামানন্দ স্বধর্মত্যাগকে ‘সাধ্যসার’ বলে অভিহিত করলেন। স্বধর্মত্যাগ বলতে বর্ণাশ্রমধর্মত্যাগ বোঝানো হচ্ছে। স্বধর্মত্যাগ শুদ্ধাভক্তির প্রথম সোপান। এর মাধ্যমে সাধকের মধ্যে কৃষ্ণসেবার মানসিকতা বিকশিত হয়। তাই এটি আগের ধাপের চেয়ে শ্রেয়। এই প্রসঙ্গে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার একটি শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন কৃষ্ণদাস কবিরাজ—
“সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ।
অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ।।”
(১৮।৬৬)
স্বধর্ম ত্যাগ করার বিষয়ে স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আশ্বাস থাকা সত্ত্বেও শ্রীচৈতন্য একে নিতান্ত বাইরের (‘এহো বাহ্য’) বলে চিহ্নিত করছেন। তার কারণ—
প্রথমত, স্বধর্মত্যাগেও কর্তব্যবুদ্ধি নিহিত রয়েছে। এর তুলনায় কর্তব্যবুদ্ধিহীন শ্রবণ-কীর্তন শ্রেয়।
দ্বিতীয়ত, স্বধর্মত্যাগের ক্ষেত্রে স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে আশ্বাস দিতে হচ্ছে, তবেই ভক্ত এই পথে অগ্রসর হচ্ছেন। একে অহৈতুকী কৃষ্ণপ্রেম বলা যায় না।
অতঃপর চতুর্থ ধাপে জ্ঞানমিশ্রা ভক্তিকে ‘সাধ্যসার’ বলে অভিহিত করছেন রায় রামানন্দ। স্বধর্মত্যাগের তুলনায় তা অবশ্যই শ্রেয়। কারণ, জ্ঞানমিশ্রা ভক্তির উত্তমা ভক্তিতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই বক্তব্যের প্রমাণস্বরূপ শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে গীতার নিম্নোক্ত শ্লোক উদ্ধৃত করা হয়েছে—
“ব্রহ্মভূতঃ প্রসন্নাত্মা ন শোচতি ন কাঙ্ক্ষতি।
সমঃ সর্বেষু ভূতেষু মদ্ভক্তিং লভতে পরাম্।।”
(১৮।৫৪)
(অনুবাদ: ব্রহ্মভূত প্রসন্নাত্মা ব্যক্তি শোক বা আকাঙ্ক্ষা করেন না। সর্বভূতে সমদৃষ্টিসম্পন্ন হয়ে তিনি আমাতে পরাভক্তি লাভ করেন।)
জ্ঞানমিশ্রা ভক্তিকেও শ্রীচৈতন্য ‘এহো বাহ্য’ বলে চিহ্নিত করেছেন। জ্ঞানের তিনটি অঙ্গ— তৎ-পদার্থের জ্ঞান (ভগবান সম্পর্কিত), ত্বং-পদার্থের জ্ঞান (জীব সম্পর্কিত) এবং উভয়ের ঐক্যজ্ঞান। এদের মধ্যে জীব ও ভগবানের ঐক্যজ্ঞান কোনোভাবেই বৈষ্ণবের অভিপ্রেত হতে পারে না— ‘মোক্ষবাঞ্ছা কৈতবপ্রধান’। এমনকি, তৎ এবং ত্বং-পদার্থের জ্ঞানও অতিরিক্ত চর্চা করলে তা ভক্তির পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। জ্ঞানের মোহ অহৈতুকী ভক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এইসব কারণে শ্রীচৈতন্য জ্ঞানমিশ্রা ভক্তিকে বাইরের বস্তু বলে চিহ্নিত করেছেন।
পঞ্চম পর্যায়ে, জ্ঞানশূন্যা ভক্তিকে ‘সাধ্যসার’ বলেছিলেন রায় রামানন্দ। জ্ঞানমিশ্রার তুলনায় তা শ্রেয় অবশ্যই। এক্ষেত্রে ভক্তিবিরোধী জীব-ভগবানের ঐক্যজ্ঞান চর্চা করা হয় না। অন্য দুই প্রকারের জ্ঞানেও অত্যধিক আকৃষ্ট হওয়ার আশঙ্কা নেই। এক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণের নিত্যদাস জীবের স্বরূপ উন্মোচিত হলেও ঈশ্বরের প্রতি প্রেমবাসনার বিকাশ নেই। তাই শ্রীচৈতন্য একে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা দেননি, কেবল ‘এহো হয়’ বলে প্রাথমিক স্বীকৃতি দিচ্ছেন।
ষষ্ঠ পর্যায়ে, রামানন্দ প্রেমভক্তিকে ‘সর্বসাধ্য সার’ বলে অভিহিত করলেন। জ্ঞানশূন্যা ভক্তির ক্রমাগত অনুশীলনের মধ্য দিয়ে প্রেমভক্তির বিকাশ ঘটে। এটি পঞ্চম পুরুষার্থ হওয়া সত্ত্বেও শ্রীচৈতন্য একে কিন্তু উত্তম সাধ্যবস্তু বলে স্বীকৃতি দিচ্ছেন না। ব্রজ, দ্বারকা ও বৈকুণ্ঠের মধ্যে কোন্ স্থানের লীলা শ্রেষ্ঠ, তা এখনও রামানন্দ ব্যাখ্যা করেননি। তা ছাড়া, ব্রজের মধ্যেও পরিদৃশ্যমান বিভিন্ন ভক্তির মধ্যে (দাস্য, সখ্য ইত্যাদি) কোন্টি শ্রেষ্ঠ, সে সম্পর্কে বিস্তারিত শুনতে ইচ্ছুক বলেই শ্রীচৈতন্য বললেন, ‘এহো হয়, আগে কহ আর’।
রামানন্দ সপ্তম ধাপে জানালেন, ‘দাস্যপ্রেম সর্বসাধ্যসার’। লক্ষণীয়, শান্ত ভক্তিরস মুখ্যাভক্তির অন্তর্গত হলেও রামানন্দ তার উল্লেখ করেননি। কারণ, বৈকুণ্ঠের ভগবৎ-পরিকরদের মধ্যে শান্তরতির বিকাশ লক্ষ করা যায়। এক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি মমতা (অর্থাৎ, মম-তা, শ্রীকৃষ্ণকে নিজের বলে ভাবা) নেই। তাই সাধ্যবস্তুর মধ্যে শান্ত ভক্তিরস পরিগণিত নয়। জীব স্বরূপত শ্রীকৃষ্ণের নিত্যদাস। তার স্বরূপানুবন্ধী কাজ আত্মসুখ বাসনাহীন কৃষ্ণসেবা। তবু দাস্যপ্রেম সম্পর্কে শ্রীচৈতন্য ‘এহো হয়’ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। কারণ, এতে সেবাবাসনার সম্যক বিকাশ নেই। দাস্যপ্রেমে ভক্তের গৌরববুদ্ধি মিশ্রিত রয়েছে। ভক্ত যে দাস— এই তাঁর গৌরব। প্রভুর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁর সেবা করা যায় না— এই সংকোচ সম্যক সেবার পক্ষে বিঘ্নজনক।
অষ্টম ধাপে সখ্যপ্রেমকে ‘সর্বসাধ্যসার’ বলে উল্লেখ করলেন রামানন্দ। সখ্যপ্রেমে ভক্তের মনে ভগবান সম্পর্কে সংকোচবোধ থাকে না। দাস্যপ্রেমের দুটি গুণ নিষ্ঠা ও সেবার সঙ্গে এখানে যুক্ত হয় সমপ্রাণতা। দাস্যপ্রেমের তুলনায় এক্ষেত্রে সেবাবাসনা বিকাশের অধিকতর সুযোগ রয়েছে। এইসব বিবেচনা করেই শ্রীচৈতন্য সখ্যপ্রেমকে ‘এহোত্তম’ বলে অভিহিত করেছেন।
নবম ধাপে, সখ্যপ্রেমের থেকেও বেশি পরিপক্ব অবস্থা বাৎসল্যপ্রেমে লভ্য। এটি উত্তম সাধ্যবস্তু, তবে একেবারে আত্মসুখ-বাসনাহীন নয়। সন্তান-পালনের আনন্দ ভক্ত লাভ করেন। তাই শ্রীচৈতন্য এর চেয়েও বেশি সান্দ্র এবং আত্মস্বার্থহীন প্রেমাবস্থা হয় কি না তা জানতে আগ্রহী।
রামানন্দ দশম ধাপে জানালেন, ‘কান্তাপ্রেম সর্বসাধ্যসার’। ‘কান্তা’ শব্দে পরকীয়া ভাবাপন্ন ব্রজগোপীদের বোঝানো হচ্ছে। সমর্থা কৃষ্ণরতির ক্রমান্বয়িক বিকাশের ক্ষেত্রে বাৎসল্যপ্রেম অনুরাগ পর্যায় পর্যন্ত বর্ধিত হতে পারে। কিন্তু কান্তাপ্রেম ভাব ও মহাভাব পর্যন্ত বর্ধিত হতে পারে। তাই বাৎসল্যপ্রেমের তুলনায় এটি উচ্চস্তরের। কান্তাপ্রেমে সর্বোচ্চ পাঁচটি গুণ লক্ষ করা যায়— নিষ্ঠা, সেবা, সমপ্রাণতা, লালন এবং কান্তভাব/ আত্মসমর্পণ। কান্তাপ্রেমের ক্ষেত্রে বেদধর্ম, লোকধর্ম ত্যাগ করে ব্রজগোপীরা নিজ-অঙ্গ দিয়ে শ্রীকৃষ্ণের সেবা করেন। প্রেমের ক্ষেত্রে গোপীদের কাছে পরাজিত শ্রীকৃষ্ণ তাঁদের ঋণ স্বীকার করেন—
“এই প্রেমার অনুরূপ না পারে ভজিতে।
অতএব ঋণী হয়— কহে ভাগবতে।।”
(২।৮।৭১)
কান্তাপ্রেমের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নিয়ে শ্রীচৈতন্যের প্রতিক্রিয়া— ‘এই সাধ্যাবধি সুনিশ্চয়’। এই প্রেম বিষয়ে আরও আলোচনা শুনতে চান তিনি।
রামানন্দ তখন একাদশ ধাপে জানালেন, কান্তাদের মধ্যে ‘রাধার প্রেম— সাধ্যশিরোমণি’। রাধাপ্রেমের মাহাত্ম্য এবং অন্য গোপীদের তুলনায় তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ব্যাখ্যা করে শোনালেন রামানন্দ। রাসলীলায় রাধিকা ব্যতীত শতকোটি গোপীতেও শ্রীকৃষ্ণের ‘কাম নির্বাপণ’ (অপ্রাকৃত ‘প্রেম’ অর্থে এই শব্দ ব্যবহৃত) হয় না। এতেই বোঝা যায় শ্রীরাধার গুণ।
এতদবধি আলোচনা শোনার পর শ্রীচৈতন্যের প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘এবে সে জানিল সেব্য-সাধ্যের নির্ণয়’।
এ-কথা বলা সত্ত্বেও আসলে শ্রীচৈতন্যের জিজ্ঞাসার এখনও পরিতৃপ্তি হয়নি। তাই এর অব্যবহিত পরেই কৃষ্ণতত্ত্ব এবং রাধাতত্ত্ব সম্পর্কে জানতে চান তিনি। সেই আলোচনা সমাপনের পর প্রেমবিলাসবিবর্ত সম্পর্কিত স্বরচিত একটি গান শোনান রায় রামানন্দ। শ্রীরাধার প্রেমের সান্দ্রতম অবস্থা হল প্রেমবিলাসবিবর্ত। প্রেমের পরিপক্বতার কারণে নায়ক-নায়িকার ভ্রান্তি বা আত্মবিস্মৃতি জন্মায়। তখন তাঁরা বিপরীত বিলাসে রত হন। প্রেমবিলাসবিবর্তে রাধাপ্রেম-মহিমার যে পরিচয় পাওয়া যায়, তাকেই চূড়ান্ত সাধ্যবস্তু বলে স্বীকার করলেন শ্রীচৈতন্য –
“প্রভু কহে— সাধ্যবস্তু এই অবধি হয়।
তোমার প্রসাদে ইহা জানিল নিশ্চয়।।”
(২।৮।১৫৮)
প্রেমবিলাসবিবর্ত আসলে শ্রীচৈতন্যরই অন্তরঙ্গ স্বরূপ। সাধ্যবস্তু সম্পর্কিত তাঁর নিরন্তর জিজ্ঞাসা আত্মস্বরূপে এসে অবশেষে পরিতৃপ্তি লাভ করল।
প্রেম পৃথিবীতে একবার মাত্র রূপ গ্রহণ করিয়াছিল, তাহা বাংলাদেশে।
—আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন
শ্রীরামানন্দ গৌড়ীয় মঠের গুগল ম্যাপ লিংক