‘কান্তা’ শব্দে পরকীয়া ভাবাপন্ন ব্রজগোপীদের বোঝায়। শ্রীকৃষ্ণকে প্রেমিক এবং নিজেকে প্রেমিকা মনে করে, স্বসুখবাসনা পরিত্যাগপূর্বক কেবল শ্রীকৃষ্ণের সুখের জন্য শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে যে সম্ভোগ-বাসনা, তাকেই বলে কান্তাপ্রেম।
বাৎসল্যপ্রেম বৃদ্ধি পেয়ে অনুরাগ পর্যন্ত যেতে পারে। কিন্তু কান্তাপ্রেম ভাব এবং মহাভাব পর্যন্ত বর্ধিত হয়। তাই কান্তাপ্রেম বাৎসল্যপ্রেম অপেক্ষা শ্রেয়।
কান্তাপ্রেমে শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য রসের গুণ নিহিত। উপরন্তু এতে থাকে কান্তভাব। অর্থাৎ, এই প্রেমে লভ্য মোট পাঁচটি গুণ হল— নিষ্ঠা, সেবা, সমপ্রাণতা, লালন, কান্তভাব।
কান্তাপ্রেমের ক্ষেত্রে গোপীরা দাস্যের মতো শ্রীকৃষ্ণের সর্ববিধ সেবা করেন, সখাদের মতো শ্রীকৃষ্ণ সম্পর্কে তাঁদের মনে কোনো সংকোচ বা গৌরববুদ্ধি থাকে না, বাৎসল্যের প্রবণতা অনুযায়ী শ্রীকৃষ্ণের মঙ্গলকামনা করেন। এই সব কিছুর পরেও কান্তাপ্রেমের মৌলিকত্ব গোপীদের নিজ অঙ্গ দিয়ে শ্রীকৃষ্ণসেবা। তাই কান্তাপ্রেমের সেবাতেই শ্রীকৃষ্ণ পরিপূর্ণ সেবা লাভ করেন। এর মধ্যে দাস্যাদি বাকি চারটি রসের সেবাও নিহিত রয়েছে।
দাস্য-সখ্য-বাৎসল্য হল সম্বন্ধানুগা রতি। এক্ষেত্রে ভক্তের চিত্ত সম্বন্ধ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় সেবাবাসনা সম্যক্রূপে বিকশিত হতে পারে না। ব্রজগোপীদের ক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে সম্বন্ধ একটি রয়েছে বটে— কান্তাকান্ত সম্বন্ধ। তবে এখানে সম্বন্ধ প্রাধান্য না-পেয়ে সেবাবাসনাই প্রাধান্য পায়। এমনকি বেদধর্ম-লোকধর্ম ত্যাগ করেও, যে-কোনো উপায়ে, ব্রজগোপীরা শ্রীকৃষ্ণকে সুখী করতে চান।
ব্রজগোপীদের এই নিঃস্বার্থ কান্তাপ্রেমের সমতুল্য প্রেমের অধিকারী স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণও নন। গোপীদের স্বসুখবাসনা না-থাকায় তাঁদের প্রেমের বিনিময়ে শ্রীকৃষ্ণ কিছুই প্রতিদান দিতে পারেন না। তা ছাড়া, গোপীরা শ্রীকৃষ্ণের জন্য সবকিছু ত্যাগ করলেও শ্রীকৃষ্ণ একজন গোপীর জন্য বাকিদের ত্যাগ করতে পারেন না। তাই তাঁর প্রেম গোপীদের মতো অনন্য নয়। এই কারণেই বলা হয়, প্রেমের ক্ষেত্রে স্বয়ং ভগবান গোপীদের কাছে ঋণী।
কান্তাপ্রেমের মধ্যে রাধার প্রেম সর্বশ্রেষ্ঠ— ‘সাধ্য শিরোমণি’। তবে রাধার প্রেম সকল অবস্থায় সমান থাকে না। রাধাপ্রেমের তীব্রতম বহিঃপ্রকাশ হল প্রেমবিলাসবিবর্ত। মাথুর পর্যায়ের চেয়েও ঘনীভূত অবস্থা এটি। বিরহে প্রেমের তীব্রতা প্রকাশিত হয় নিঃসন্দেহে। তবু মাথুর পর্যায়ে রাধিকার এই চেতনা থাকে যে, তিনি রাধিকা; এবং শ্রীকৃষ্ণ ভিন্ন দেহধারী। কিন্তু প্রেমবিলাসবিবর্তে এই চেতনাও লুপ্ত হয়। শ্রীরাধা এবং শ্রীকৃষ্ণ বিস্মৃত হন তাঁদের আত্মপরিচয়। তাই রাধাপ্রেমের তীব্রতম অবস্থা প্রেমবিলাসবিবর্ত।
সূত্র: শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, মধ্যলীলা, অষ্টম পরিচ্ছেদ, শ্লোক ৬৩-৭৫ অবলম্বনে আলোচিত