রাধা পূর্ণশক্তি কৃষ্ণ পূর্ণশক্তিমান।
দুই বস্তু ভেদ নাহি শাস্ত্র পরমাণ।।
শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত (১।৪।৯৫)
রাধা পূর্ণশক্তি কৃষ্ণ পূর্ণশক্তিমান।
দুই বস্তু ভেদ নাহি শাস্ত্র পরমাণ।।
শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত (১।৪।৯৫)
শ্রীকৃষ্ণের অনন্ত শক্তির মধ্যে তিনটি প্রধান — অন্তরঙ্গা শক্তি বা চিচ্ছক্তি বা স্বরূপ শক্তি, তটস্থা শক্তি বা জীবশক্তি এবং বহিরঙ্গা শক্তি বা মায়াশক্তি। এদের মধ্যে স্বরূপ শক্তিকে আবার পুনরায় তিনটি ভাগে ভাগ করা যায় — সদংশে সন্ধিনী, চিদংশে সংবিৎ, আনন্দাংশে হ্লাদিনী। এরা যথাক্রমে শ্রীকৃষ্ণের অস্তিত্ব, জ্ঞান এবং আনন্দ-প্রাপ্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। বিশেষত উল্লেখ্য, হ্লাদিনী শক্তি স্বয়ং ভগবানকে আনন্দ দেয় এবং এর দ্বারা তিনি ভক্তদেরও আনন্দ দেন। হ্লাদিনীর সার প্রেম। অর্থাৎ, শ্রীকৃষ্ণকর্তৃক নিক্ষিপ্তা হ্লাদিনী শক্তি ভক্তের মনে কৃষ্ণেন্দ্রিয়-প্রীতি-ইচ্ছা রূপে প্রকাশিত হয়। একেই বলে প্রেম। সমর্থা কৃষ্ণরতির বিকাশের পর্যায়ে প্রেম ক্রমশ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে মহাভাবে পরিণত হয়। মহাভাবের অন্তর্গত একটি বিশেষ পর্যায় মাদনাখ্য মহাভাবের মূর্ত রূপ হলেন শ্রীরাধা। জগতে শ্রীকৃষ্ণের প্রেয়সী রূপেই তাঁর খ্যাতি। শ্রীরাধা হলেন পূর্ণশক্তি, শ্রীকৃষ্ণ পূর্ণশক্তিমান। উভয়ের মূলত ভেদ নেই। লীলারস আস্বাদনের জন্য কেবল তাঁরা দুই রূপ ধারণ করেছেন।
চিন্তামণি যেমন মানুষের সকল বাঞ্ছা পূরণ করে, শ্রীরাধাও তেমন শ্রীকৃষ্ণের সকল বাঞ্ছা পূরণ করেন। স্বয়ং ভগবানের ইচ্ছাপূরণে সমর্থ শ্রীরাধিকা।
ললিতা-বিশাখাদি সখীরা হলেন রাধিকার কায়ব্যূহরূপ। তাঁরা শ্রীরাধার থেকে স্বতন্ত্র নন। একই সময়ে বহু কার্য করার উদ্দেশ্যে এক দেহকে অলৌকিক উপায়ে অনেক দেহরূপে প্রকাশ করলে, তাদের বলে কায়ব্যূহ। তবে এক্ষেত্রে কায়ব্যূহের বাহ্যিক আকার মূল দেহের অনুরূপ থাকে। সখীরা বাহ্যিকভাবে রাধিকার তুলনায় ভিন্ন দেখতে ছিলেন বলে তাঁদের বলা হয় কায়ব্যূহরূপ। শ্রীকৃষ্ণের বহুকান্তার সঙ্গে লীলা করার ইচ্ছা পূরণ করার জন্য রাধিকার থেকে সখীদের উদ্ভব।
শ্রীরাধার বয়ঃসন্ধি কারুণ্যামৃত ধারায় প্রাতঃকালীন প্রথম স্নান, তাঁর নবযৌবন তারুণ্যামৃত ধারায় মধ্যাহ্ন-স্নান এবং তাঁর যৌবন লাবণ্যামৃত ধারায় সায়াহ্ন-স্নানের সঙ্গে তুলনীয়। এই ত্রিকালীন স্নান দ্বারা বোঝান হচ্ছে শ্রীরাধার দেহ করুণা, নবযৌবন এবং লাবণ্যের মূল আশ্রয়।
রাধিকার বস্ত্র-অলংকারাদি প্রত্যেকটি উপাদান আসলে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি প্রেমেরই বহিঃপ্রকাশ। যেমন, রাধিকার শ্যামবর্ণ শাড়ি তাঁর লজ্জার সঙ্গে তুলনীয়। তাঁর অরুণরাঙা উত্তরীয় আসলে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি অনুরাগ। অনুরূপভাবে, আরও কয়েকটি সমতুল্য উপাদানের তালিকা দেওয়া হল —
কুঙ্কুম= সৌন্দর্য
চন্দন= সখীদের প্রণয়
কর্পূর= স্মিতহাস্য
মৃগনাভি= উজ্জ্বল রস
কেশবিন্যাস= প্রচ্ছন্ন মান
পটবাস (সুগন্ধিচূর্ণ)= ধীরাধীরাত্মক গুণ
তাম্বুল রাগ= রাগ
কাজল= প্রেমকৌটিল্য
অলংকার= সূদ্দীপ্ত সাত্ত্বিক ভাব এবং সঞ্চারী ভাবসমূহ
পুষ্পমালা= গুণশ্রেণি
তিলক= সৌভাগ্য
হারের মধ্যমণি রত্ন= প্রেমবৈচিত্ত্য
নিত্যকৈশোর= সখী
গৃহ= অঙ্গসৌরভ
কর্ণের অলংকার= শ্রীকৃষ্ণনাম ইত্যাদি।
শ্রীকৃষ্ণকে শ্যামরস (শৃঙ্গার রস) পান করান শ্রীরাধা। এমনকি সৌভাগ্যবতী সত্যভামাও রাধিকার মতো সৌভাগ্য বাঞ্ছা করেন। ব্রজগোপীরা রাধিকার কাছে কলা-বিলাস শেখেন। লক্ষ্মী-পার্বতী রাধিকার মতো সৌন্দর্য চান, তাঁর মতো পাতিব্রত্য-ধর্ম বাঞ্ছা করেন অরুন্ধতী।
সূত্র: শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, মধ্যলীলা, অষ্টম পরিচ্ছেদ, শ্লোক ১১৬-১৪৬ অবলম্বনে আলোচিত