শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থের আদিলীলা তৃতীয় এবং চতুর্থ পরিচ্ছেদে শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবের যথাক্রমে বহিরঙ্গ এবং অন্তরঙ্গ কারণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
ভক্ত যে-জন্য পৃথিবীতে ঈশ্বরের অবতরণ প্রার্থনা করেন, তাকে বলে অবতারত্বের বহিরঙ্গ বা গৌণ কারণ।
আর স্বয়ং ঈশ্বর যে উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য পৃথিবীতে অবতরণের সিদ্ধান্ত নেন, সেটি হল অন্তরঙ্গ বা মুখ্য কারণ।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, শ্রীচৈতন্য অবতার নন। তিনি পূর্ণ ভগবান।
বহিরঙ্গ কারণ
আদিলীলা তৃতীয় পরিচ্ছেদে ‘অনর্পিতচরীং চিরাৎ’ শ্লোকটির ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।[১] সংক্ষেপে এই শ্লোকের অর্থ: দীর্ঘকাল যা অর্পণ করা হয়নি, সেই উন্নত[২]-উজ্জ্বল[৩] স্বভক্তিসম্পদ[৪] দান করার জন্য কলিযুগে শচীনন্দন আবির্ভূত হয়েছেন। এটি শ্রীচৈতন্যরূপে শ্রীকৃষ্ণ-শ্রীরাধার আবির্ভাবের বহিরঙ্গ কারণ মাত্র।
শ্রীকৃষ্ণের ব্রজলীলার[৫] দুই ভাগ — প্রকট এবং অপ্রকট।
গোলোকে[৬] অপ্রকট অবস্থায় চলে ভগবানের নিত্যলীলা। এই লীলার আদিও নেই, অন্তও নেই। দ্বাপর যুগে সংঘটিত হয়েছিল ভগবানের প্রকট ব্রজলীলা।[৭]
এই লীলা সমাপ্তির পর শ্রীকৃষ্ণ ভাবলেন, বহুকাল জগতে প্রেমভক্তি[৮] দান করা হয়নি। ফলে পৃথিবীর মানুষ ঐশ্বর্যজ্ঞানযুক্ত বিধিভক্তি[৯] অবলম্বন করেছে। এই বিধিমার্গে উপাসনা করে বৈকুণ্ঠে যাওয়া যায়, কিন্তু ব্রজের শ্রীকৃষ্ণকে পাওয়া যায় না। ভগবান সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি যুগধর্ম প্রবর্তন করবেন।
সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর এবং কলিযুগের ধর্ম যথাক্রমে ধ্যান, যজ্ঞ, সাধন এবং নাম-সংকীর্তন। যুগধর্ম প্রবর্তন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের কাজ নয় — এটি বস্তুত যুগাবতারের[১০] কাজ।
তবে বর্তমান কলিযুগে শ্রীকৃষ্ণ শ্রীচৈতন্যরূপে আবির্ভূত হওয়ার সময় যুগাবতারও তাঁর সঙ্গেই আবির্ভূত হন। ভগবান যুগাবতারের মাধ্যমে নাম-সংকীর্তন প্রচার করান। অন্যদিকে, ব্রজের চার রকমের প্রেম (দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য, মধুর) দান করা যুগাবতারের পক্ষে সম্ভব নয়।
শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থে বলা হয়েছে—
যুগধর্মপ্রবর্তন হয় অংশ হৈতে।
আমা বিনা অন্যে নারে ব্রজপ্রেম দিতে।। (১।৩।২০)
নাম-সংকীর্তন প্রচার এবং ব্রজের চতুর্বিধ প্রেমভক্তি দান — এই দুই উদ্দেশ্য হল শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবের বহিরঙ্গ কারণ।[১১]
এই দুই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ভগবান নিজের পরিকরদের সঙ্গে নিয়ে প্রকট নবদ্বীপলীলায় আবির্ভূত হন।
কিন্তু নাম ও প্রেম প্রচারের জন্য রাধিকার ভাব ও কান্তি অবলম্বন করে শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাবের কোনো প্রয়োজন ছিল না। তাঁর স্বয়ং আগমনই যথেষ্ট ছিল। রাধাকৃষ্ণ যুগলরূপের কেন প্রয়োজন হল, তা শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবের অন্তরঙ্গ কারণ থেকে জানা যায়।
অন্তরঙ্গ কারণ
শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থের আদিলীলা চতুর্থ পরিচ্ছেদে ‘শ্রীরাধায়াঃ প্রণয়মহিমা’ শ্লোকটির ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।[১২]
এই শ্লোকের সংক্ষিপ্ত বঙ্গানুবাদ: শ্রীরাধার প্রেমের মাহাত্ম্য কীরূপ, শ্রীরাধার আস্বাদ্য শ্রীকৃষ্ণের মাধুর্য কীরূপ এবং শ্রীকৃষ্ণের মাধুর্য আস্বাদন করে শ্রীরাধা কীরূপ সুখ পান— এই তিনটি বিষয় জানার জন্য শ্রীকৃষ্ণ নবদ্বীপলীলার সূচনা করেন।
এই শ্লোক থেকে শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবের অন্তরঙ্গ কারণ জানা যায়। কৃষ্ণদাস কবিরাজ শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবের অন্তরঙ্গ কারণ সাধারণভাবে ব্যাখ্যা করছেন এইভাবে—
“আপনে আস্বাদে প্রেম নামসংকীর্তন” (১।৪।৩৫)।
সাধারণ বয়ানে প্রেম এবং নাম আস্বাদনকে[১৩] অন্তরঙ্গ কারণ বলে চিহ্নিত করা হলেও বস্তুত মূল কারণ হিসাবে কাজ করেছিল শ্রীকৃষ্ণের তিনটি অপূর্ণ বাসনা—
রাধাভাব অঙ্গীকরি — ধরি তার বর্ণ।
তিন সুখ আস্বাদিতে হব অবতীর্ণ।। (১।৪।২২৩)
পার্থিব জীবনের শেষপর্যায়ে দিব্যোন্মাদ অবস্থায় শ্রীচৈতন্য তাঁর অন্তরঙ্গ পার্ষদ স্বরূপ দামোদরকে এই তিনটি অপূর্ণ বাসনার কথা জানিয়েছিলেন।
নীচে এই বিষয়ে সবিস্তারে আলোচনা করা হল —
১। শ্রীকৃষ্ণের চিচ্ছক্তির অন্তর্গত মাদন নামক মহাভাবের মূর্ত রূপ হলেন শ্রীরাধা। শ্রীকৃষ্ণ পূর্ণশক্তিমান, শ্রীরাধা আসলে তাঁর শক্তি। লীলারস আস্বাদনের জন্য ব্রজে তাঁরা পৃথক শরীরে আবির্ভূত। ব্রজলীলায় শ্রীকৃষ্ণ রাধিকার প্রেম বিষয়রূপে আস্বাদন করেছিলেন। কিন্তু বিষয় আলম্বনের তুলনায় আশ্রয় আলম্বনের সুখ কোটি গুণ বেশি। শ্রীকৃষ্ণ মাদনাখ্য প্রেমের আশ্রয়জাতীয়[১৪] আনন্দ পেতে চান, রাধিকার প্রণয়মহিমা জানতে চান — এটিই হল তাঁর প্রথম অপূর্ণ বাঞ্ছা।[১৫]
২। শ্রীকৃষ্ণের মাধুর্য আস্বাদন করেন শ্রীরাধা। আবার, রাধিকার এমনই গুণ, তাঁর সংস্পর্শে শ্রীকৃষ্ণের মাধুর্য আরও বৃদ্ধি পায়। উভয়ের মধ্যে যেন এক প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। রাধিকার প্রেম এবং শ্রীকৃষ্ণের মাধুর্য — উভয়ই ক্রমবর্ধমান। শ্রীকৃষ্ণের মাধুর্যের প্রতি সকলে আকৃষ্ট — নরনারী, উদ্ভিদ, পশুপাখি। এমনকি, শ্রীকৃষ্ণ নিজেও তাঁর মাধুর্যের প্রতি আকৃষ্ট। নিজের মাধুর্য আস্বাদনের লোভ জন্মালেও ব্রজলীলায় তা সম্ভব নয়। স্বমাধুর্য আস্বাদনের এই আকাঙ্ক্ষাই শ্রীকৃষ্ণের দ্বিতীয় অপূর্ণ বাঞ্ছা।[১৬]
৩। ব্রজগোপীদের প্রেমে আত্মসুখবাসনা থাকে না। শ্রীকৃষ্ণের প্রতিজ্ঞা ছিল — ভজনকারীকে তিনি আকাঙ্ক্ষিত ফল দান করবেন। অথচ, গোপীরা কৃষ্ণসুখব্যতীত আর কিছু আকাঙ্ক্ষা করেন না। তাই ব্রজগোপীদের কাছে শ্রীকৃষ্ণের প্রতিজ্ঞাভঙ্গ হয়। গোপীশ্রেষ্ঠ রাধিকা শ্রীকৃষ্ণের মাধুর্য আস্বাদন করে কীরূপ সুখ পান — এই জিজ্ঞাসাই হল শ্রীকৃষ্ণের তৃতীয় অপূর্ণ বাঞ্ছা।[১৭]
অন্তরঙ্গ কারণরূপে বর্ণিত এই তিনটি অপূর্ণ বাঞ্ছার মধ্যে আবার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হল তৃতীয় বাঞ্ছাটি।[১৮]
শ্রীকৃষ্ণের মূল লক্ষ্য ছিল শ্রীরাধার তুল্য সুখ পাওয়া (তৃতীয় বাঞ্ছা)।
রাধিকা কেন সুখ পান?
কারণ, তিনি শ্রীকৃষ্ণের মাধুর্য আস্বাদন করেন (দ্বিতীয় বাঞ্ছা)।
শ্রীকৃষ্ণ কীভাবে এই সুখ পেতে পারেন?
যদি তিনি শ্রীরাধা হয়ে জন্মগ্রহণ করেন, তবে মাদনাখ্য প্রেমের আশ্রয়জাতীয় সুখ পাওয়া সম্ভব (প্রথম বাঞ্ছা)।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, তৃতীয় বাঞ্ছাটিই মূল অন্তরঙ্গ কারণ। তৃতীয় বাঞ্ছার সূত্র ধরে দ্বিতীয় এবং প্রথম বাঞ্ছার আগমন।
এই তিন বাঞ্ছা পূরণের জন্য শ্রীকৃষ্ণ যখন পৃথিবীতে আবির্ভূত হবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তখন শ্রীঅদ্বৈত আচার্য শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাবের জন্য প্রার্থনা শুরু করেন। তাঁর আহ্বান শ্রীকৃষ্ণকে পৃথিবীতে আবির্ভাবের সময় নির্ধারণে সাহায্য করেছে।[১৯] তবে এই আহ্বানকে ভগবানের আবির্ভাবের মুখ্য কারণ বলা যায় না। মূলত পূর্বোক্ত তিনটি অপূর্ণ বাঞ্ছার কারণেই রাধিকার ভাব ও কান্তি গ্রহণ করে নবদ্বীপলীলায় জন্মগ্রহণ করলেন শ্রীগৌরাঙ্গসুন্দর।
অন্ত্যটীকা
[১] আদিলীলা, প্রথম পরিচ্ছেদ, চতুর্থ সংস্কৃত শ্লোক দ্রষ্টব্য—
অনর্পিতচরীং চিরাৎ করুণয়াবতীর্ণঃ কলৌ
সমর্পয়িতুমুন্নতোজ্জ্বলরসাং স্বভক্তিশ্রিয়ম্।
হরিঃ পুরটসুন্দরদ্যুতিকদম্বসন্দীপিতঃ
সদা হৃদয়কন্দরে স্ফুরতু বঃ শচীনন্দনঃ॥
[২] মধুর রসকে ‘উন্নত’ কেন বলা হচ্ছে?
এখানে উন্নত মানে বুঝতে হবে সর্বাপেক্ষা উন্নত। রসগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা উন্নত হল মধুর রস।
[৩] মধুর রসকে ‘উজ্জ্বল’ কেন বলা হচ্ছে?
যাতে কোনো মালিন্য নেই, তা-ই হল উজ্জ্বল। মালিন্য হল আত্মসুখবাসনা। মধুর রসে বিন্দুমাত্র আত্মস্বার্থ বা মালিন্য নেই, সেই কারণে মধুর রস হল উজ্জ্বল।
[৪] ‘স্বভক্তিসম্পদ’ বলতে কী বোঝায়?
শ্রীকৃষ্ণ-বিষয়ক ভক্তিসম্পদ। জীব শ্রীকৃষ্ণের নিত্যদাস। তার কাজ শ্রীকৃষ্ণের সেবা করা। এই সেবার একমাত্র উপায় ভক্তি। মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য সার্থক করে তোলে ভক্তি। তাই একে ‘সম্পদ’ বলা হচ্ছে।
ভক্তির উৎস কী? ভক্তি কোথা থেকে আসে?
শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি হল ভক্তির মূল উৎস। সূর্য যেমন সমগ্র পৃথিবীতে আলো দেয়, কিন্তু একমাত্র উদ্ভিদ সেই আলো থেকে খাদ্য-সংশ্লেষ করতে পারে; ঠিক তেমনই শ্রীকৃষ্ণ তাঁর হ্লাদিনী শক্তিকে সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দেন। কেবল ভক্তের হৃদয়ে সেই হ্লাদিনী শক্তি ভক্তিতে পরিণত হয়।
[৫] ব্রজলীলার দুই ভাগের বিষয়টি দেখে নেওয়া যাক —
অপ্রকট ব্রজলীলা:
শ্রীকৃষ্ণ পরিকরদের সঙ্গে গোলোকে নিত্যলীলা করেন। নিত্যলীলার আদি এবং অন্ত নেই। ফলে অপ্রকট ব্রজলীলায় কারো বয়স বাড়ে না। ভগবান এখানে চিরকিশোর।
এই লীলা কিন্তু একাকী হচ্ছে না। এখানে শ্রীকৃষ্ণের পরিকরগণ রয়েছেন।
এই নিত্যলীলার স্থান গোলোক কোথায় অবস্থিত? মহাকাশে একটি সহস্রদল পদ্মের মতো দেখতে ভগবানের ধাম রয়েছে বলে মনে করা হয়। এটিই নিত্যলীলার স্থান গোলক। বৃন্দাবন, গোকুল, গোলোক, ব্রজ ইত্যাদি শব্দকে মোটামুটি সমার্থক বলে ধরা যেতে পারে। সামান্য ফারাক রয়েছে (৬ সংখ্যক পাদটীকা দ্রষ্টব্য)।
এই লীলা সাধারণ ভক্তের দৃষ্টিগোচর নয়। তাই এর নাম অপ্রকট ব্রজলীলা।
প্রকট ব্রজলীলা:
এই লীলা হয় প্রাকৃত ব্রহ্মাণ্ডে (অর্থাৎ, পৃথিবীতে)। ফলে সাধারণ ভক্তের দৃষ্টিগোচর লীলা। তাই এর নাম প্রকট ব্রজলীলা।
শ্রীকৃষ্ণ তাঁর প্রকট ব্রজলীলার পরিকরদের নিয়ে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন।
সাধারণ মানুষের মতো তাঁর বয়স বাড়ে। ভগবান এখানে চিরকিশোর নন।
প্রকট লীলা শেষ হলে ভগবান আবার গোলোকে ফিরে যান। অপ্রকট নিত্যলীলা চলতে থাকে।
ব্রজলীলার যেমন দুই ভাগ; একইভাবে নবদ্বীপলীলারও দুই ভাগ— অপ্রকট এবং প্রকট। এদের মধ্যে প্রকট নবদ্বীপলীলায় শ্রীচৈতন্য জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে। সেই লীলা সাধারণ মানুষের দৃষ্টিগোচর ছিল। বর্তমানে প্রকট নবদ্বীপলীলা সমাপ্ত হয়েছে, কিন্তু অপ্রকট নবদ্বীপলীলা এখনও চলছে। কোথায় চলছে? পৃথিবীর নবদ্বীপে নয়, অলৌকিক নবদ্বীপে। ড. রাধাগোবিন্দ নাথ এই অপ্রকট লীলার ধাম নবদ্বীপকে ‘চিন্ময় নবদ্বীপ’ বলে অভিহিত করেছেন। গৌরাঙ্গসুন্দরের নবদ্বীপলীলা এখনও থামেনি। প্রকৃত ভক্ত সেই অপ্রকট লীলা দেখতে পান। শ্রীচৈতন্যভাগবত জানাচ্ছেন—
অদ্যাপিহ সেই লীলা করে গোরা রায়।
কোনো কোনো ভাগ্যবানে দেখিবারে পায়।।
[৬] গোলোক, বৃন্দাবন (ব্রজ) এবং গোকুলের মধ্যে পার্থক্য কোথায়?
ভক্তের বিশ্বাস, মহাকাশে এক হাজার দলবিশিষ্ট একটি পদ্মফুল রয়েছে। এর নাম গোকুল। এখানে শ্রীকৃষ্ণ আত্মীয় পরিজনের (শ্রীরাধা, নন্দ, যশোদা প্রমুখ) সঙ্গে বাস করেন। এই গোকুলের অত্যন্ত নিকটে অবস্থিত বৃন্দাবন (ব্রজ)। আর গোকুলের বাইরের অংশকে বলে গোলোক। গোলোক বাইরের দিকে অবস্থিত বলে তার তুলনায় গোকুলের মহিমা অধিক। সাধারণ ব্যবহারে, ‘গোলোক’ শব্দে গোলোক, বৃন্দাবন (ব্রজ) এবং গোকুল তিনটি স্থানকেই বোঝানো হয়ে থাকে।
[৭] প্রকট লীলা যখন চলে তখন ভগবান পরিকরদের সঙ্গে পৃথিবীতে আবির্ভূত হন। তাহলে তখন গোকুল/ গোলোক কি ফাঁকা থাকে?
না। ভগবান (এবং তাঁর পরিকরগণ) বহুমূর্তিধারী। অর্থাৎ, তাঁরা একই সময়ে একাধিক স্থানে বিরাজ করতে পারেন। তাই পৃথিবীতে যখন প্রকট লীলা চলে, তখনও সপার্ষদ ভগবানের একটি রূপ গোকুলে থাকে। গোকুল/ গোলোক কখনোই জনশূন্য থাকে না।
[৮] প্রেমভক্তি= পঞ্চম পুরুষার্থ। আত্মসুখ বাসনাহীন শুদ্ধ মধুররস।
[৯] বিধিভক্তি মানে কী?
বিধি মানে নিয়ম— শাস্ত্রের নিয়ম। ধর্মশাস্ত্রের নীতি অনুযায়ী যে পূজার্চনা, তাকে বলে বিধিভক্তি। এই ভক্তিতে শাস্ত্রের ভয়ে মানুষ ধর্মপালন করে, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের প্রতি প্রাণের টান নেই। অন্যদিকে, ঐশ্বর্যজ্ঞানহীন রাগাত্মিকা এবং রাগানুগা মার্গের ভক্তিতে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি সত্যকারের প্রেম প্রকাশিত। এদের মধ্যে রাগাত্মিকা ভক্তি ব্রজ-পরিকরদের মধ্যে দেখা যায় এবং রাগানুগা ভক্তি সাধারণ মানুষের মধ্যে দেখা যায়। রাগাত্মিকার অনুগামী বলে এই ভক্তির নাম রাগানুগা।
[১০] যুগাবতার কাকে বলে? পূর্ণ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং যুগাবতারের পার্থক্য কী?
সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর এবং কলির ধর্ম (যথাক্রমে ধ্যান, যজ্ঞ, সাধন পরিচর্যা এবং নাম-সংকীর্তন) প্রতিষ্ঠা করার জন্য ভগবানের যে দূত পৃথিবীতে আবির্ভূত হন; তিনি হলেন যুগাবতার। একটি নির্দিষ্ট কার্য সাধনের জন্য যুগাবতারের আগমন। তাঁকে পূর্ণ ভগবানের মর্যাদা দেওয়া যায় না। কলিকালে নাম-সংকীর্তন প্রচার যুগাবতারের কাজ— শ্রীকৃষ্ণের বা শ্রীচৈতন্যের কাজ নয়।
[১১] শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত থেকে —
চতুর্থ শ্লোকের অর্থ এই কৈল সার।
প্রেম নাম প্রচারিতে এই অবতার।।
সত্য এই হেতু কিন্তু এহো বহিরঙ্গ।
আর এক হেতু শুন আছে অন্তরঙ্গ।। (১।৪।৪-৫)
[১২] আদিলীলা প্রথম পরিচ্ছেদের ষষ্ঠ সংস্কৃত শ্লোক দ্রষ্টব্য—
শ্রীরাধায়াঃ প্রণয়মহিমা কীদৃশো বানয়ৈবা-
স্বাদ্যো যেনাদ্ভুতমধুরিমা কীদৃশো বা মদীয়ঃ ৷
সৌখ্যং চাস্যা মদনুভবতঃ কীদৃশং বেতি লোভাৎ
তদ্ভাবাঢ্যঃ সমজনি শচীগর্ভসিন্ধৌ হরীন্দুঃ ৷৷
[১৩] প্রেম ও নাম আস্বাদন বলতে কী বোঝায়?
আস্বাদন দু’রকমের হতে পারে — বিষয়রূপে আস্বাদন এবং আশ্রয়রূপে আস্বাদন। ধরা যাক, মীরা বাঈ শ্রীকৃষ্ণের প্রতি মধুর রসাত্মক রাগানুগা ভক্তি প্রকাশ করেছেন। এই ভক্তিরসের আশ্রয় আলম্বন (= যার মনে অনুভূতি জন্মাচ্ছে) হলেন মীরা বাঈ এবং বিষয় আলম্বন (= যাকে দেখে/ যে-কারণে অনুভূতি জন্মাচ্ছে) হলেন শ্রীকৃষ্ণ। এই ভক্তিরস মীরা বাঈ আশ্রয়রূপে আস্বাদন করেন এবং শ্রীকৃষ্ণ বিষয়রূপে আস্বাদন করেন।
ঠিক একইভাবে, ব্রজলীলায় নাম এবং প্রেম শ্রীকৃষ্ণ বিষয়রূপে আস্বাদন করেছিলেন। সেখানে নাম-প্রেম আশ্রয়রূপে আস্বাদন করেছিলেন ব্রজগোপী এবং শ্রীকৃষ্ণের অন্যান্য পরিকরগণ। নবদ্বীপলীলায় যেহেতু রাধাকৃষ্ণ একই দেহে আবির্ভূত, এখানে নাম-প্রেম আশ্রয়রূপে আস্বাদন করতে পারলেন শ্রীকৃষ্ণ।
[১৪] লক্ষণীয়, মাদনাখ্য মহাভাব কেবল শ্রীরাধার মধ্যে পাওয়া যায়। অন্যান্য ব্রজগোপীদের মধ্যে তা পাওয়া যায় না। এমনকি, স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মধ্যেও পাওয়া যায় না। তাই মাদনাখ্য প্রেমের আশ্রয় একমাত্র শ্রীরাধা। শ্রীকৃষ্ণ এই প্রেমের বিষয়। মাদনাখ্য প্রেম আশ্রয়রূপে আস্বাদন করতে হলে রাধিকা হয়ে জন্মানো ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তাই নবদ্বীপলীলায় শ্রীকৃষ্ণ শ্রীরাধার সঙ্গে একদেহে আবির্ভূত হন।
[১৫] শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত থেকে —
বিষয়জাতীয় সুখ আমার আস্বাদ।
আমা হৈতে কোটিগুণ আশ্রয়ের আহ্লাদ।।
আশ্রয়জাতীয় সুখ পাইতে মন ধায়।
যত্নে আস্বাদিতে নারি কি করি উপায়।। (১।৪।১১৫-১১৬)
[১৬] শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত থেকে —
কৃষ্ণের মাধুরী কৃষ্ণে উপজায় লোভ।
সম্যক আস্বাদিতে নারে মনে রহে ক্ষোভ।। (১।৪।১৩৫)
[১৭] শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত থেকে —
আমা হৈতে রাধা পায় যে জাতীয় সুখ।
তাহা আস্বাদিতে আমি সদাই উন্মুখ।। (১।৪।২১৭)
[১৮] ড. রাধাগোবিন্দ নাথ তৃতীয় বাঞ্ছাকে বলেছেন, ‘মুখ্যকারণ-সমূহের মধ্যেও মুখ্যতম’। ড. নাথের বইতে ১।৪।২১৮ শ্লোকের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।
[১৯] “অবতীর্ণ হইবেন বলিয়াই শ্রীকৃষ্ণ কৃতনিশ্চয় হইয়াছিলেন; কিন্তু কোন্ সময় অবতীর্ণ হইবেন, তাহা স্থির করেন নাই; অদ্বৈতের ইচ্ছা তাহা স্থির করিয়া দিল…” — ড. রাধাগোবিন্দ নাথ। ১।৩।৮৯ শ্লোকের আলোচনা দ্রষ্টব্য।