শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান। তিনি সচ্চিদানন্দতনু। অর্থাৎ, তাঁর শরীর অপ্রাকৃত। ব্রহ্মসংহিতা জানাচ্ছেন,
“ঈশ্বরঃ পরমঃ কৃষ্ণঃ সচ্চিদানন্দবিগ্রহঃ।” (৫।১)
ব্রজেন্দ্র-নন্দন শ্রীকৃষ্ণ সর্বৈশ্বর্যপূর্ণ, সর্বশক্তিমান, সর্বরসপূর্ণ। এইরকম বিরাট-তত্ত্ব হয়েও তিনি শ্রীরাধার প্রেমের বশীভূত। শ্রীকৃষ্ণের শক্তির সংখ্যা অগণন। এইসব শক্তির যা বহিঃপ্রকাশ, তাকে বলে ঐশ্বর্য। এরা হল— ঐশ্বর্য, বীর্য, যশ, বৈরাগ্য, জ্ঞান, শ্রী।
প্রাকৃত বস্তুতে কামনার জন্য যিনি দায়ী, তিনি কামদেব। অন্যদিকে, শ্রীকৃষ্ণের সৌন্দর্য-মাধুর্যাদি সবকিছুই অপ্রাকৃত। শ্রীকৃষ্ণ নিজের অপ্রাকৃত তনুর প্রতি কামনা সৃষ্টি করেন বলে তাঁকে বলা হয় ‘অপ্রাকৃত নবীন মদন’ বা অপ্রাকৃত কামদেব। প্রাকৃত জগতে কাম্যবস্তু লাভের পর লালসার নিবৃত্তি ঘটে। কিন্তু অপ্রাকৃত কাম্যবস্তু শ্রীকৃষ্ণকে পাওয়ার পরে তাঁকে পাওয়ার বাসনা আরও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। এমনই মহিমাসম্পন্ন শ্রীকৃষ্ণের ধাম শ্রীবৃন্দাবন।
কামগায়ত্রী এবং কামবীজে শ্রীকৃষ্ণের উপাসনা করা হয়। বৈদিক গায়ত্রীমন্ত্রের রসাত্মক রূপ কামগায়ত্রী। বৈদিক গায়ত্রীর একাধিক অর্থ থাকা সম্ভব। এমনকি, এর কোনো অর্থ ব্রহ্মের ঐশ্বর্যপ্রধান রূপকেও বোঝাতে পারে। কিন্তু কামগায়ত্রীর কেবল একটি অর্থই হয়। সেটি হল— অপ্রাকৃত নবীন মদন। আর কামবীজ হল— ক্লীঁ। বৃহদ্গৌতমীয়তন্ত্র মতে কামবীজের অর্থ নিম্নরূপ—
ক = শ্রীকৃষ্ণ
ঈ-কার = শ্রীরাধা
ল = রাধাকৃষ্ণের প্রেমসুখ
নাদবিন্দু (ঁ) = রাধাকৃষ্ণের পরস্পর চুম্বনানন্দ-মাধুর্য
বস্তুত, কামবীজ রাধাকৃষ্ণের যুগলস্বরূপকে বুঝিয়ে থাকে। তত্ত্বগতভাবে কামবীজ (ক্লীঁ) এবং প্রণব (ওঙ্কারধ্বনি) অভিন্ন। তবে প্রণব ব্রহ্মস্বরূপ হওয়ায় অত্যন্ত ব্যাপক। পক্ষান্তরে, কামবীজ হল প্রণবের রসাত্মক রূপ।
পুরুষ কিংবা নারী, স্থাবর বৃক্ষলতাদি কিংবা জঙ্গম প্রাণীগণ— সকলেই শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আকৃষ্ট। বিভিন্ন ভক্ত শান্ত-দাস্যাদি বিভিন্ন রসকে অবলম্বন করে তাঁর উপাসনা করে। এই সমস্ত রসের বিষয় এবং আশ্রয় আলম্বন হলেন শ্রীকৃষ্ণ।
মুখ্য এবং গৌণ ভক্তিরসগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ হল শৃঙ্গার (মধুর) রস। তাই এটি রসরাজ আখ্যায় ভূষিত। শ্রীকৃষ্ণের সচ্চিদানন্দময় বিগ্রহ রসরাজ শৃঙ্গারের প্রতিমূর্তি। তিনিই মূর্তিমান শৃঙ্গার রস। নারায়ণ, লক্ষ্মী প্রমুখ দেবদেবীরাও তাঁর প্রতি আকৃষ্ট। এমনকি, শ্রীকৃষ্ণ নিজেও নিজের চিত্ত হরণ করেন। শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে বলা হয়েছে—
“আপন মাধুর্যে হরে আপনার মন।
আপনে আপনা চাহে করিতে আলিঙ্গন।।”
(২।৮।১১৪)
অর্থাৎ, স্বয়ং ভগবানের মধ্যেও অপূর্ণতা রয়েছে। এই অপূর্ণতাই তাঁর শ্রীচৈতন্যরূপে জন্মগ্রহণের অন্যতম কারণ।
সূত্র: শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, মধ্যলীলা, অষ্টম পরিচ্ছেদ, শ্লোক ১০৬-১১৪ অবলম্বনে আলোচিত