ভগবানের লীলা অনেক— দানলীলা, নৌকালীলা, বস্ত্রহরণলীলা ইত্যাদি। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এইসব লীলার একটাই উদ্দেশ্য— ভক্তকে শিক্ষা দেওয়া। নিছক তাত্ত্বিক ধর্মীয় আলোচনা সাধারণ মানুষের বোধগম্য নয়, কিছুটা ক্লান্তিকরও বটে। তাই গল্পের ছলে তত্ত্বকে আকর্ষক করে তোলার জন্য লীলার অবতারণা। শ্রীকৃষ্ণের সমস্ত লীলার মধ্যে রাসলীলার গুরুত্ব সমধিক।
সংস্কৃত ভাষায় ‘রাস’ বলতে আক্ষরিক অর্থে বোঝায় শব্দ করা। মনিয়ের উইলিয়ামস তাঁর সংস্কৃত-ইংরেজি অভিধানে জানাচ্ছেন, এর মূলে রয়েছে √রা নামক ধাতু। ‘রাসক’ নামের দৃশ্যকাব্যের সঙ্গে রাসের সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন মনিয়ের উইলিয়ামস। আবার কোনো কোনো পণ্ডিত বলেছেন, রস এবং রাস সম্পর্কিত। বাচস্পত্যম্ অভিধান মতে, ‘রস’ শব্দের সঙ্গে ঘঞ্ প্রত্যয় যোগ করে ‘রাস’ শব্দ নিষ্পন্ন হয়। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’-এও একই ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। রস কাকে বলে? সাহিত্যের শিক্ষার্থীরা বলবেন, বিভাব-অনুভাব-ব্যভিচারিভাবের সংযোগে রসনিষ্পত্তি হয়। সাধারণ মানুষের কাছে এইগুলি দুর্বোধ্য পারিভাষিক শব্দ মাত্র। সহজভাবে বলা যায়, মানুষের মনের অন্তর্নিহিত অনুভূতি যখন উপযুক্ত পরিবেশে বিকশিত হয়, তাকেই বলে রস। শ্রুতি বলেছেন, “রসো বৈ সঃ।” তিনিই রস— সচ্চিদানন্দ ব্রহ্ম বা শ্রীকৃষ্ণই রস। কোন্ রস? শ্রীকৃষ্ণ মধুর রসের মূর্ত বিগ্রহ। তিনিই আনন্দ।
কিন্তু এই আনন্দদায়িনী মধুর রসের লীলা যে-কোনো অবতারের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারী ‘রাসলীলা প্রবেশিকা’ নামক ভাষ্যগ্রন্থে ব্যাখ্যা করেছেন, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম ইত্যাদি অবতারের মধ্যে মাধুর্য লভ্য নয়। এমনকি, শ্রীরামচন্দ্রের মধ্যেও ঐশ্বর্যভাবের আড়ালে গৌণ হয়ে গেছে মাধুর্যভাব। এই মাধুর্য পূর্ণভাবে বিকশিত হয়েছে শ্রীকৃষ্ণের ব্রজলীলায়। এই ব্রজলীলায় অংশগ্রহণ যে-কোনো কারো সাধ্য নয়। শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে লীলায় অংশগ্রহণকারীদের মোটামুটি চারটি ক্রমোচ্চ শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। সুধী পাঠক, উপর থেকে নীচে চারটি সিঁড়ি কল্পনা করে নিন। সর্বোচ্চ ধাপে রয়েছেন শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রীরাধা। শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান। তাঁর শক্তিস্বরূপিণী হলেন শ্রীরাধা। তিনি আলাদা কোনো ব্যক্তি নন। শ্রীরাধা জীবাত্মার প্রতীক কিংবা শ্রীকৃষ্ণের প্রেমিকাও নন। তিনি এবং শ্রীকৃষ্ণ বস্তুত অভিন্ন। ভগবানের এক বিশেষ প্রকার শক্তি (হ্লাদিনী শক্তি) হলেন শ্রীরাধা।
রাধা-কৃষ্ণের ঠিক নীচের স্তরে রয়েছেন ব্রজগোপীগণ। তাঁরাও রাসলীলার অংশীদার। শ্রীরাধা যেমন আলাদা কোনো ব্যক্তি নন, তিনি শ্রীকৃষ্ণেরই শক্তি; একইভাবে গোপীরাও আলাদা কোনো ব্যক্তি নন। তাঁরা শ্রীরাধার অংশ। পারিভাষিকভাবে গোপীদের বলা হয় ‘কায়ব্যূহরূপ’। অর্থাৎ, শ্রীরাধার থেকে অলৌকিক উপায়ে তাঁদের সৃষ্টি। তাঁরা শ্রীরাধারই প্রতিরূপ। দর্পণ প্রতিবিম্বের যেমন আলাদা অস্তিত্ব নেই, গোপীরাও তেমনই শ্রীরাধার প্রতিবিম্বস্বরূপ। রাধাকৃষ্ণ এবং গোপীগণ অপ্রাকৃত তথা অলৌকিক স্তরের বলে পরিগণিত। সাধারণ মানুষের পরকীয়া প্রেমের সঙ্গে রাধাকৃষ্ণের অপ্রাকৃত প্রেমলীলা তুলনীয় নয়। আপাতভাবে ব্রজগোপীদের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের প্রেম পরকীয়া; কিন্তু নিবিড় তাত্ত্বিক বিচারে এই প্রেম ভগবানের নিজের সঙ্গে নিজের লীলা।
ব্রজলীলায় তৃতীয় স্তরে গোপীগণের অব্যবহিত নীচের পর্যায়ে রয়েছেন মঞ্জরীগণ। রাধাকৃষ্ণ এবং গোপীগণের সেবা করা তাঁদের ধর্ম। আর চতুর্থ তথা সর্বনিম্ন স্তরে রয়েছেন সাধারণ ভক্তগণ। এই শেষ দুটি ধাপ প্রাকৃত বা লৌকিক পর্যায়ের। এই চারটি ধাপ নিয়েই শ্রীকৃষ্ণের প্রকট ব্রজলীলা।
রাসলীলার ভাষাতাত্ত্বিক এবং ধর্মীয় ব্যাখ্যা এতদবধি সংক্ষেপে আলোচনা করা হল। কিন্তু কেমন হয় এই লীলা? ভাগবতপুরাণের দশম স্কন্ধে পাঁচটি অধ্যায় (২৯-৩৩) জুড়ে রাসলীলার বিবরণ রয়েছে। এখানে অবশ্য তিথি হল শারদ পূর্ণিমা। শ্রীকৃষ্ণের বংশীধ্বনি শুনে গোপীগণ (ভাগবতপুরাণে স্পষ্টভাবে শ্রীরাধার নামোল্লেখ করা হয়নি) নিজ নিজ গৃহ থেকে বেরিয়ে এলেন। শ্রীকৃষ্ণ সাংসারিক কর্তব্যের কথা স্মরণ করালেও তাঁরা মানতে নারাজ। বেদধর্ম-লোকধর্ম ত্যাগ করে গোপীগণ শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত। তাঁরা গৃহে ফিরে যেতে নারাজ। শুরু হল সম্মিলিত নৃত্যগীত। ভগবানের অলৌকিক মহিমায় প্রত্যেক গোপীরই উপলব্ধি হল, যেন শ্রীকৃষ্ণ তাঁর সঙ্গেই রয়েছেন। এই সম্মিলিত আনন্দনৃত্যই রাসলীলা। ভগবানের মাধুর্যভাবের পৌরাণিক অভিকরণ।
বাঙালির সংস্কৃতিতে রাসলীলা সাড়ম্বরে উদ্যাপিত। পশ্চিমবঙ্গের নবদ্বীপে কার্তিক মাসের রাসপূর্ণিমা সর্ববৃহৎ আঞ্চলিক উৎসবের মর্যাদা পেয়েছে। বস্তুত দুর্গাপুজোর থেকেও বেশি উদ্দীপনার সঙ্গে নবদ্বীপে রাস পালিত হয়। রাসলীলার শিকড় বৈষ্ণব ধর্মে নিহিত থাকলেও নবদ্বীপে রাসপূর্ণিমায় শক্তিদেবীরাও উপাসিত হন। তাই বর্তমানে এটি শাক্তরাস নামেও অভিহিত। এছাড়াও শান্তিপুর, কোচবিহার, দাঁইহাট, তমলুক, কালনা ইত্যাদি বৈষ্ণবধামেও রাসলীলা লোকজ সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে মথুরা-বৃন্দাবন, অসম, মণিপুর, রাজস্থানে রাসলীলা পালিত হয়। বাংলাদেশেও কতিপয় বৈষ্ণব প্রভাবান্বিত স্থানে, বিশেষত বঙ্গীয় এবং মণিপুরি সংস্কৃতির অঙ্গ হিসাবে, রাসলীলা উদ্যাপিত হয়।
বাংলা সাহিত্যের কথা না বললে বাঙালির সংস্কৃতির কথা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। বাংলা সাহিত্যের আদি গ্রন্থ ‘চর্যাগীতিকোষবৃত্তি’ বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকদের দ্বারা রচিত। এই গ্রন্থে বৈষ্ণবীয় রাসের প্রসঙ্গ না থাকাই স্বাভাবিক। তবে ‘লীলা’ শব্দটি রয়েছে (চতুর্দশ চর্যাগীতি দ্রষ্টব্য)। রাসলীলার প্রথম স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া গেল বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের বৃন্দাবনখণ্ডে। জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দম্’ কাব্যেও রাসলীলা রয়েছে। তবে সেই রাস উদ্যাপিত হয় কংসবধের পরে। অন্যদিকে, বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্যের বাসন্তী রাসলীলা কংসবধের পূর্বেই অনুষ্ঠিত। মালাধর বসু ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ কাব্যে সংক্ষিপ্ত আকারে রাসলীলার প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবের পর বৈষ্ণব সাহিত্যে মধুর রসের জোয়ার এল। ‘শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’ থেকে শুরু করে ভারতচন্দ্রের কাব্য— মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে রাসলীলার প্রসঙ্গ ফিরে এসেছে বারবার। বৈষ্ণব পদাবলিতেও রাসলীলার প্রসঙ্গ গুরুত্ব সহকারে উপস্থাপিত হল। একটিমাত্র উদাহরণ দেওয়া যাক। গোবিন্দদাসের রাসলীলা বিষয়ক বিখ্যাত পদ—
শরদ চন্দ পবন মন্দ
বিপিনে তরল কুসুমগন্ধ
…
হেরত রাতি ঐছন ভাতি
শ্যামমোহন মদনে মাতি
মুরলি গান পঞ্চম তান
কুলবতী চিত চোরণী।
ব্রজবুলির লালিত্যে, বর্ণনার পরিচ্ছন্নতায়, ভক্তির আবেগে এই পদ বাঙালি জাতির সম্পদ।
এতসব তাত্ত্বিক আর সাংস্কৃতিক আলোচনার বাইরেও রাসলীলা একজন আধুনিক বাঙালির জীবনে কী বোধ বয়ে আনে? সুধী পাঠক কল্পনা করুন, পূর্ণিমার রাত্রি। যমুনাবিপিনে গোপীরা বৃত্তাকারে নৃত্যরতা। বৃত্তের কেন্দ্রে রয়েছেন রাধাকৃষ্ণ। মুহূর্তের জন্য সরে গেল এই ছবি। দ্বিতীয় ছবিতে পরমাণুর কেন্দ্রে রয়েছে নিউক্লিয়াস। প্রোটন-নিউট্রন। বৃত্তাকারে ঘিরে রেখেছে ইলেকট্রন মেঘ। আবার পালটে গেল দৃশ্যপট। তৃতীয় ছবিতে সৌরমণ্ডল। কেন্দ্রে স্থিত সূর্য। চারপাশে প্রদক্ষিণ করে চলেছে গ্রহ-গ্রহাণু। এই বিশ্ব-প্রপঞ্চের অন্তর্গত যে নৃত্যলীলা, যে ছন্দ; তারই নাম রাস।