রায় রামানন্দের কাছে শ্রীকৃষ্ণতত্ত্ব এবং শ্রীরাধাতত্ত্ব সম্পর্কিত আলোচনা শোনার পর শ্রীচৈতন্য উভয়ের বিলাস-মহত্ত্ব শুনতে চান। রামানন্দ জানান, ধীরললিত নায়ক শ্রীকৃষ্ণ দিবারাত্র শ্রীরাধার সঙ্গে লীলা করেন। এই বক্তব্যের যাথার্থ্য মেনে নিয়েও শ্রীচৈতন্য বিস্তারিতভাবে রাধাকৃষ্ণের লীলামাহাত্ম্য জানতে চান। তখন রায় রামানন্দ রাধাকৃষ্ণের প্রেমের সর্বোত্তম বিকাশ প্রেমবিলাসবিবর্তের উদাহরণস্বরূপ স্বরচিত একটি সংগীত শোনান—
পহিলহি রাগ নয়ন-ভঙ্গ ভেল।
অনুদিন বাঢ়ল অবধি না গেল।।
না সো রমণ না হাম রমণী।।
দুহুঁ মন মনোভব পেশল জানি।।
এ সখি সো সব প্রেমকাহিনি।
কানুঠামে কহবি বিছুরহ জনি।।
না খোঁজলুঁ দূতি না খোঁজলুঁ আন।
দুহঁক মিলনে মধ্যত পাঁচ-বাণ।।
অব সো বিরাগে তুহুঁ ভেলি দূতি।
সুপুরুখ-প্রেমক ঐছন রীতি।।
গানের বক্তব্য এইরকম— নয়নের পলক পড়তে-না-পড়তেই প্রথম রাগের উৎপত্তি হল। এটি মঞ্জিষ্ঠা রাগের বৈশিষ্ট্য। কালক্রমে এই রাগ বৃদ্ধি পেল। রাধিকা জানাচ্ছেন, শ্রীকৃষ্ণ এবং তাঁর আত্মবোধ লুপ্ত হয়েছে। উভয়ের মনোবাসনা যেন পিষ্ট হয়ে অভিন্ন হয়ে গেছে। কে পুরুষ, কে নারী— তা তাঁরা বিস্মৃত হয়েছেন। শ্রীরাধার অনুরোধ, সখী যেন এই প্রেমকাহিনি শ্রীকৃষ্ণকে জানান। রাধাকৃষ্ণের প্রেমে দূতী বা অন্য কোনো তৃতীয় ব্যক্তির প্রয়োজন হয়নি। প্রেমে মধ্যস্থতা করেছিলেন স্বয়ং কন্দর্প। এখন অবশ্য পরিস্থিতি ভিন্ন। শ্রীকৃষ্ণ অনুরাগ ভুলেছেন। তাই প্রয়োজন পড়েছে দূতীর। রাধিকার জিজ্ঞাসা, সুপুরষের প্রেমের কি এমনই রীতি?
এই গানের বিশেষত প্রথমাংশে প্রেমবিলাসবিবর্তের স্বরূপ উদ্ঘাটিত। ‘প্রেমবিলাস’ শব্দের অর্থ প্রেমজনিত বিলাস বা কেলি। ‘বিবর্ত’ শব্দটির তিনটি অর্থ —
১। পরিপক্ব অবস্থা,
২। ভ্রান্তি,
৩। বৈপরীত্য।
এদের মধ্যে প্রথমটি মুখ্যার্থ, বাকি দুটি গৌণার্থ। বিলাসের পরিপক্ব বা চরমোৎকর্ষ অবস্থায় নায়ক-নায়িকার মনে ভ্রান্তি জন্মায়। অর্থাৎ, আত্মবোধ বিলুপ্ত হয়ে কে পুরুষ, কে নারী — তা তাঁরা ভুলে যান। অপর পক্ষের বিলাসজনিত আনন্দ কীভাবে বৃদ্ধি পাবে, সেটাই হয় তখন তাঁদের একমাত্র বিবেচ্য বিষয়। এই ঐকান্তিক প্রয়াস থেকে প্রেমলীলায় নায়ক-নায়িকার ভূমিকার বৈপরীত্য লক্ষ করা যায়। আলিঙ্গন-চুম্বনাদি, বেশরচনা ইত্যাদি বিষয়ে কখনও শ্রীকৃষ্ণ অগ্রণী হন, কখনও বা শ্রীরাধা। রামানন্দের সংগীতে ‘না সো রমণ না হাম রমণী’ বাক্যে এই বৈপরীত্যের কথা পরিস্ফুট। এক্ষেত্রে বৈপরীত্য ঘটে নায়ক-নায়িকার অজ্ঞাতসারে। প্রেমের চরমোৎকর্ষ অবস্থায় ভ্রান্তি বা আত্মবিস্মৃতিজনিত কারণে বিপরীত বিহার ঘটলে তাকে প্রেমবিলাসবিবর্ত বলে। তাই নায়ক-নায়িকার স্বেচ্ছাকৃত বিপরীত বিহারকে প্রেমবিলাসবিবর্ত বলা যায় না। শ্রীচৈতন্য প্রেমবিলাসবিবর্তকে সাধ্যবস্তুর চূড়ান্ত সীমা বলে স্বীকার করেছেন —
“প্রভু কহে — সাধ্যবস্তু অবধি এই হয়।
তোমার প্রসাদে ইহা জানিল নিশ্চয়।।” (২।৮।১৫৭)
রাধাকৃষ্ণের ব্রজলীলার চেয়েও নিবিড় প্রেম লক্ষ করা যায় প্রেমবিলাসবিবর্তে। রাধাপ্রেম মহিমা তথা মাদনাখ্য-মহাভাবের চরমতম বিকাশ প্রেমবিলাসবিবর্ত। এক্ষেত্রে শ্রীরাধা যেন প্রেমে গলে গিয়ে প্রতি অঙ্গ দ্বারা শ্রীকৃষ্ণের প্রতি অঙ্গকে আলিঙ্গন করে রেখেছেন। এই অন্তঃকৃষ্ণ-বহির্গৌর যুগলসত্তা আসলে শ্রীচৈতন্যের স্বরূপ। শ্রীকৃষ্ণ সম্যক্রূপে শ্রীরাধার বশ্যতা স্বীকার করায় নায়িকার স্বাধীনভর্তৃকাত্ব এবং নায়কের ধীরললিত্বের চরম বিকাশ সাধিত হয়েছে প্রেমবিলাসবিবর্তে। এইরূপ একাত্মতা ব্রজলীলাতেও লভ্য নয়। সাধারণত দেখা যায়, নায়ক অগ্রণী হয়ে নায়িকাকে আলিঙ্গন করেন। প্রেমবিলাসবিবর্তে শ্রীরাধা যেন নায়কের ভূমিকা পালন করে শ্রীকৃষ্ণকে নিত্য-আলিঙ্গন করে রয়েছেন। রাধাভাবের প্রভাবে শ্রীকৃষ্ণ আত্মস্বরূপ বিস্মৃত হয়েছেন। শ্রীচৈতন্যের ব্যবহারের মধ্যে ভ্রান্তি বা আত্মবিস্মৃতি এবং যুগলসত্তার বৈপরীত্যময় পরিপূর্ণ বিকাশ লক্ষ করা যায়। তা ছাড়া, প্রেমবিলাসবিবর্তের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য — মিলনের মধ্যেও বিরহের ভাব। এই বৈশিষ্ট্যও শ্রীচৈতন্যের গম্ভীরালীলায় প্রকাশিত। এইসব কারণে সিদ্ধান্ত করা হয়, শ্রীচৈতন্য প্রেমবিলাসবিবর্তের মূর্ত রূপ।
প্রেমবিলাসবিবর্ত সম্পর্কিত রায় রামানন্দের পূর্বোক্ত সংগীত শোনার পর শ্রীচৈতন্য স্বহস্তে রামানন্দের মুখ ঢেকে দেন। কবিকর্ণপূর ‘শ্রীচৈতন্যচন্দ্রোদয়’ নাটকে এই আচরণের দু-রকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন —
প্রথমত, আনন্দ-বৈবশ্য হেতু শ্রীচৈতন্য রামানন্দের মুখ ঢেকে দেন। রামানন্দ প্রেমবিলাসবিবর্ত সম্পর্কিত তত্ত্ব সবিস্তারে ব্যাখ্যা করলে শ্রীচৈতন্যের পক্ষে উচ্ছ্বসিত ভাবতরঙ্গ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে যেত। তাই সংযম রক্ষার জন্য তিনি রামানন্দের মুখাচ্ছাদন করেন।
দ্বিতীয়ত, প্রেমবিলাসবিবর্তের মূর্ত বিগ্রহ শ্রীচৈতন্য। এই সম্পর্কিত আলোচনা আরও এগোলে তাঁর স্বরূপ প্রকাশিত হয়ে যেত। অথচ, স্বরূপ প্রকাশের তখনও সময় হয়নি। কারণ, জীবের পক্ষে যা নিতান্ত প্রয়োজনীয়, সেই সাধনতত্ত্ব সম্পর্কিত আলোচনা তখনও আরম্ভ হয়নি। রামানন্দ গৌরাঙ্গের স্বরূপ চিনে ফেললে তাঁর মুখ থেকে সাধনতত্ত্বের ব্যাখ্যা আর শোনা হত না।
তৃতীয় একটি কারণের ইঙ্গিত কবিকর্ণপূর দিয়েছেন। রামানন্দের গানের প্রথমাংশে নিরুপাধি প্রেমের (সম্ভোগ অবস্থা) কথা বলা হয়েছে। সেই কথা শুনে শ্রীচৈতন্যের চিত্তে যে অপূর্ব আনন্দের সঞ্চার হয়েছে, গানের শেষাংশে সোপাধিক প্রেমের (বিপ্রলম্ভ অবস্থা) কথা বিস্তারিতভাবে শুনলে তা তিরোহিত হত। তাই প্রেমাবেশ অক্ষুণ্ণ রাখার স্বার্থে শ্রীচৈতন্য রামানন্দের মুখাচ্ছাদন করেন। কবিকর্ণপূরের এই ব্যাখ্যা কিয়দংশে গ্রাহ্য হলেও একে মুখাচ্ছাদনের গৌণ কারণ বলাই শ্রেয়।